ফাইল ফটো
নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকা কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সব প্রগতিশীল আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে উল্লেখ করেন, কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা। তার জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালে। তখন বাঙালি মুসলমান নারীদের লেখাপড়ার সুযোগ একেবারে সীমিত থাকলেও তিনি নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া শেখেন এবং ছোটবেলা থেকেই কবিতাচর্চা শুরু করেন। সুললিত ভাষায় ও ব্যঞ্জনাময় ছন্দে তার কবিতায় ফুটে উঠত সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও সমাজের সার্বিক চিত্র। তিনি নারীসমাজকে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার, মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে তিনি আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, কবি সুফিয়া কামাল পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের শিক্ষা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অবদানের জন্য তাকে ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাহিত্যে সৃজনশীলতা ছিল অবিস্মরণীয়। শিশুতোষ রচনা ছাড়াও দেশ, প্রকৃতি, গণতন্ত্র, সমাজ সংস্কার এবং নারীমুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখনী আজও পাঠককে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান তিনি। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে গঠিত আন্দোলনে কবি যোগ দেন। বেগম সুফিয়া কামাল শিশু সংগঠন ‘কচি-কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে ছাত্রী হল নির্মাণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কবি বেগম সুফিয়া কামাল যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে নির্মমভাবে হত্যা করে যখন এ দেশের ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয়, তখনও তার সোচ্চার ভূমিকা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল।
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদের রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।
১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারী জাগরণ ও নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।
সাঁঝের মায়া, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া সোভিয়েতের দিনগুলো এবং একাত্তরের ডায়েরি তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।
সুফিয়া কামাল দেশবিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।
সুফিয়া কামালের পাঁচ সন্তান। তারা হলেন– আমেনা আক্তার, সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল, শাহেদ কামাল ও সাজেদ কামাল।